যোগাযোগ মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যোগাযোগ মানুষ, দেশ এবং সমাজকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ নানাভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে আসছে। এখন আমরা রেডিও, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট, টেলিফোন, মোবাইল ফোন বা সেল ফোন ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও ই-মেইল ব্যবহার করে মুহূর্তের মাঝে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত যোগাযোগ করতে পারি। যোগাযোগ মানুষের জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিয়েছে, তাকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির চরম শিখরে। সমাজ, দেশ আর বিশ্বে অর্থপূর্ণ এবং উন্নত জীবন যাপন করতে হলে বিভিন্ন মানুষ, দেশ ও সমাজের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতেই হবে। এই অধ্যায়ে আমরা যোগাযোগ, এর নীতিমালা এবং যোগাযোগের বিভিন্ন কৌশল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:
একটি বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে একজন বা অনেকজনের সাথে ডিজিটাল তথ্য বিনিময় করা যায় ।
১৩.১.১ যোগাযোগ কী?
‘যোগাযোগ” শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। প্রতিদিন আমরা হাজার রকম যোগাযোগ করছি। যেমন সড়কপথের যোগাযোগ, নৌপথে যোগাযোগ কিংবা আকাশ পথে যোগাযোগ। এসব বলতে বোঝায় গাড়ি, রেল, নৌকা, স্টিমার ও বিমানকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য যায়গায় যাওয়া বা কোনো মালপত্র পৌঁছে দেয়া। আজকে আমরা একটু ভিন্ন ধরনের যোগাযোগের কথা বলব। এর নাম তথ্য যোগাযোগ। ভোর বেলা যখন তোমার ঘড়ির অ্যালার্ম বাজে এবং তুমি ঘুম থেকে উঠ, সেটি হচ্ছে ঘড়ির সাথে তোমার যোগাযোগ। টেলিভিশনে বা রেডিওতে খবর শুনছ বা কোনো অনুষ্ঠান দেখছ বা শুনছ—এটাও এক ধরণের যোগাযোগ। টেলিফোনে কোনো ট্যাক্সি ক্যাবকে তোমার বাসায় ডাকলে সেটিও যোগাযোগ। এই যে লেখাটা তুমি পড়ছ বা ক্লাসে তোমার শিক্ষকের কথা শুনছ, তাঁকে প্রশ্ন করছ, তাঁর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ— এগুলো সবই কোনো না কোনো ধরনের যোগাযোগ। সুতরাং যোগাযোগ হলো, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে বা এক যন্ত্র থেকে অন্য যন্ত্রে কথা-বার্তা, চিন্তাভাবনা বা তথ্যের আদান-প্রদান বা বিনিময় করা।
১৩.১.২ যোগাযোগের মৌলিক নীতিমালা
১৩.১.৩ যোগাযোগের প্রক্রিয়া ও এর ধাপ
যোগাযোগের জন্য প্রেরক বার্তাকে কোনো এক ধরনের সংকেতে রূপ দিয়ে সেটি কোনো মাধ্যম দিয়ে প্রেরণ করে। গ্রাহক সংকেতরূপী বার্তা গ্রহণ করে এর অর্থ উদ্ধার করে এবং প্রয়োজন হলে সাড়া প্রদান করে বা উত্তর দেয় (চিত্র ১৩.০১)। এ সাড়া বা উত্তরকে পাঠানো হয় প্রেরকের কাছে, এ কাজটিকে বলা হয় ফিডব্যাক। এভাবে যোগাযোগ প্রক্রিয়া চলতে থাক যেকোনো ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থায় থাকে একটি প্রেরক যন্ত্র, একটি যোগাযোগমাধ্যম এবং একটি গ্রাহকযন্ত্র। অধিকাংশ যোগাযোগব্যবস্থার মেসেজ বা বার্তাটি তৈরি করে কোনো ব্যক্তি। পরে তা প্রেরকযন্ত্রের সাহায্যে যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে প্রেরণ করা হয়। গ্রাহকযর এ বার্তা গ্রহণ করে অপর কোনো ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। এগুলোই হলো যোগাযোগের ধাপ ।
১৩.১.৪ যোগাযোগের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
যোগাযোগ হলো তথ্য আদান-প্রদানের মূল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মানুষ তার চিন্তা, ধারণা, অনুভব একে অন্যের কাছে প্রকাশ করে বা পৌঁছে দেয়। মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ একে অন্যের সাথে নানাভাবে যোগাযোগ করছে। এখন আমরা মুহূর্তের মধ্যে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও ই-মেইলের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগযোগ করতে পারি।কোনো সমস্যা সমাধান বা সম্পর্কের উন্নতি নির্ভর করে সার্থক এবং কার্যকর যোগাযোগের উপর। পড়ালেখা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, পরিবহন ব্যবস্থাপনা, অপরাধী ধরা, অপরাধ দমন ইত্যাদি সব কাজ সার্থকভাবে ও দ্রুত সম্পাদন করা যায় উন্নত যোগাযোগের মাধ্যমে। তথ্য বিনিময়, কোনো পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, কোনো যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ, মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদান করে মানুষকে প্রভাবিত করা ইত্যাদি সব কাজই যোগাযোগের দ্বারা করা সম্ভব। ইলেকট্রনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের দিন দিন পৌঁছে দিচ্ছে উন্নতির শিখরে। প্রতিদিনই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। তাই এ যুগকে বলা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ।
১৩.২.১ মাইক্রোফোন
কোনো সভা বা অনুষ্ঠানে বক্তারা যে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন তাকে মাইক্রোফোন বলে। মাইক্রোফোন বক্তার কন্ঠস্বরকে বিদ্যুৎ সংকেত বা তড়িৎ সংকেতে রূপান্তর করে। সেই বিদ্যুৎ সংকেতকে এমপ্লিফায়ার দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং স্পিকারে পাঠানো হয়। স্পিকার সেটাকে শব্দে রূপান্তর করে এবং শ্রোতারা লাউড স্পিকারে জোরে শুনতে পান। তোমরা যখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করো তখন বাইরে থেকে দেখা না গেলেও তোমরা আসলে মোবাইল ফোনের মাইক্রোফোনে কথা বল এবং স্পিকারে শুনতে পাও।
মাইক্রোফোনের কার্যক্রম দৈনন্দিন কিংবা বিশেষ কাজে ব্যবহারের জন্য নানা ধরনের মাইক্রোফোন রয়েছে, ১৩.০৩ চিত্রে সেরকম সাধারণ একটি মাইক্রোফোনের গঠন দেখানো হলো। এই মাইক্রোফোনের সামনে ধাতুর একটি পাতলা পাত বা ডায়াফ্রাম থাকে ।ডায়াফ্রামের সাথে একটা চলকুণ্ডলী (Coil) লাগানো থাকে যেটি ছবিতে দেখানো উপায়ে একটা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ভেতর নাড়া চড়া করতে পারে। যখন কেউ এই মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলে তখন ডায়াফ্রামটি শব্দ তরঙ্গের কম্পনের সাথে কাঁপতে থাকে। ডায়াফ্রামের সাথে লাগানো চলকুণ্ডলীটিও চৌম্বক ক্ষেত্রে সামনে পিছনে নড়তে থাকে। চৌম্বক ক্ষেত্রে একটি চলকুণ্ডলী নাড়াচড়া করলে সেখানে একটি বিদ্যুৎ শক্তির আবেশ হয়, কাজেই মাইক্রোফোনটি শব্দ-শক্তিটিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে একটি বৈদ্যুতিক সিগন্যাল পাঠায়।শব্দের এই বৈদ্যুতিক সিগন্যাল বা সিগন্যাল শব্দের নিখুঁত উপস্থাপন হলেও এর মান খুবই কম থাকে তাই তাকে ব্যবহার করার জন্য এমপ্লিফায়ারে বাড়িয়ে নিতে হয়। তারপর সেটি শুধু স্পিকারে নয়, টেলিফোন লাইনে, রেডিও সম্প্রচারে বা রেকর্ডিংয়ে ব্যবহার করা যায়।
১৩.২.২ স্পিকার
স্পিকার মাইক্রোফোনের ঠিক বিপরীত কাজটি করে অর্থাৎ বিদ্যুৎ শক্তিটিকে শব্দের রূপান্তর করে। ১৩.০৪ চিত্রে একটি স্পিকারের গঠন দেখানো হলো, মাইক্রোফোনের ডায়াফ্রামের বদলে স্পিকারে চলকুণ্ডলী বা Coll টি কাগজ বা হালকা ধাতুর তৈরি একটি কোন (Cone) বা শঙ্কুর সাথে লাগানো থাকে। যখন শব্দ থেকে তৈরি বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে এমপ্লিফায়ার দিয়ে বিবর্ধিত করে স্পিকারে পাঠানো হয়, তখন কাগজ বা হালকা ধাতুর তৈরি কোনটি সামনে পিছনে কম্পিত হয়ে যথাযথ শব্দ তৈরি করে।
সংকেত হলো কোনো চিহ্ন বা কার্য বা শব্দ যেটি নির্দিষ্ট তথ্য বহন করে। তথ্য বহন করার জন্য নানা ধরনের মাধ্যমে নানা ধরনের সংকেত ব্যবহার করা সম্ভব। এই অধ্যায়ে আমরা শুধু বৈদ্যুতিক বা তড়িত সংকেতের মাঝে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।সংকেত প্রেরণের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ইলেক্ট্রিক্যাল সংকেতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: এনালগ ও ডিজিটাল।
এনালগ সংকেত
আমাদের চারপাশে প্রতিমুহূর্তে যা ঘটেছে, যেমন শব্দ, আলো চাপ তাপমাত্রা বা অন্য কিছু সেগুলোকে আমরা কোনো এক ধরনের তথ্য বা উপাত্ত হিসেবে প্রকাশ করি। তাদের মান নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। আমাদের নানা কাজে সেই মানের প্রয়োজন হতে পারে, তাই সেই মান আমরা সংরক্ষণ করি, বিশ্লেষণ করি কিংবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় প্রেরণ করি। উপাত্ত প্রক্রিয়া করার জন্য আমরা ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করতে পারি। নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হতে থাকা এই তথ্য বা উপাত্তকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে পরিবর্তন করা সম্ভব এবং এই ধরনের সংকেত বা সিগন্যালকে আমরা বলি এনালগ সংকেত বা এনালগ সিগন্যাল। এই এনালগ সিগন্যালকে যদি সরাসরি কোনো এক ধরনের ইলেকট্রনিক্স দিয়ে আমরা প্রক্রিয়া করি, তাহলে সেটাকে বলা হয় এনালগ ইলেকট্রনিক্স।
ডিজিটাল সংকেত
নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হতে থাকা তথ্য বা উপাত্তের এই সিগন্যালকে সম্পূর্ণ অন্যভাবে প্রক্রিয়া করা সম্ভব। সেটি করার জন্য একটু পর পর তার মানটি কত বের করে কোনো এক ধরনের সংখ্যার প্রকাশ করে নিতে হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যাটির মানকে সংরক্ষণ করতে হয়। যখন সংকেতের মানকে সংখ্যায় বা ডিজিটে পরিবর্তন করে নেয়া হয়, তখন তাকে আমরা বলি ডিজিটাল সংকেত। আমরা তখন ডিজিটাল সংকেতের এই সংখ্যাগুলো আমাদের প্রয়োজনমতো ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে প্রক্রিয়া করতে পারব। যখন আবার সেটিকে তার মূল এনালগ সিগন্যালে পরিবর্তন করতে হয়, তখন ধারাবাহিকভাবে সংরক্ষিত মানের সমান বৈদ্যুতিক সিগন্যাল তৈরি করে নিতে হয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে দশ ভিত্তিক দশমিক (Decimal) সংখ্যা ব্যবহার করি। কিন্তু ইলেকট্রনিক্সে সংখ্যা প্রকাশ করা হয় বাইনারি সংখ্যা দিয়ে, কারণ তাহলে খুব সহজেই কোনো একটি নির্দিষ্ট ভোল্টেজকে ১ এবং শূন্য ভোল্টেজকে ০ ধরে প্রক্রিয়া করা যায়। এই ধরনের ইলেকট্রনিক্সকে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স (চিত্র ১৩.০৫ ) বলা হয়। ইলেকট্রনিক্সের সবচেয়ে বড় অবদান কম্পিউটার এবং কম্পিউটারে সকল তথ্যের আদান-প্রদান বা তথ্য প্রক্রিয়া হয় ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স দিয়ে। ইন্টারনেট বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কেও ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে তথ্য আদান প্রদান করা হয়। শব্দ ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি সিগন্যালগুলো শুরু হয় এনালগ সিগন্যাল হিসেবে এবং ব্যবহারও হয় এনালগ সিগন্যাল হিসেবে কিন্তু সেগুলো ডিজিটাল সিগন্যাল হিসেবে সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণ বা প্রেরণ করা হয়। এনালগ সিগন্যালে খুব সহজেই নয়েজ (Nolse) প্রবেশ করে সিগন্যালের গুণগত মান নষ্ট করতে পারে। একবার সেটি ডিজিটাল সিগন্যালে পরিবর্তিত করে নিলে সেখানে Noise এতো সহজে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। কাজেই সিগন্যালের গুণগত মান অবিকৃত থাকে।
ডিজিটাল সিগন্যাল প্রক্রিয়া করার জন্য বিশেষ ধরণের আইসি তৈরি করা হয়। এই আইসিগুলো ধীরে ধীরে অনেক ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে। অর্থাৎ অনেক কম সময়ে নির্ভুলভাবে অনেক বেশি পরিমাণ ডিজিটাল সিগন্যালে প্রক্রিয়া করতে পারে। কাজেই যতই দিন যাচ্ছে, ডিজিটাল প্রক্রিয়া করার বিষয়টি ততই সহজ হয়ে যাচ্ছে এবং এটি বলা বাহুল্য নয় যে আমাদের চারপাশের জগৎটি একটি ডিজিটাল জগতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন খুবই পরিচিত একটি বিষয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজ থেকে শুরু করে পেশাগত জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই করে ফেলতে পারি। ঊনবিংশ শতকে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের বিকাশ উন্নয়নে মানুষের যোগাযোগে আর ক্ষমতা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগের বিপ্লব এনেছে রেডিও, টেলিভিশন, সেলফোন বা ফ্যাক্স। সাম্প্রতিক কালে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট।
১৩.৪.১ রেডিও
রেডিও (চিত্র ১৩.০৬) বিনোদন ও যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রেডিওতে আমরা খবরের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য গান বাজনা এমনকি পণ্যের বিজ্ঞাপনও শুনতে পারি। সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী তথ্য আদানপ্রদানের জন্য নিজস্ব রেডিও ব্যবহার করে। মোবাইল বা সেলুলার টেলিফোন যোগাযোগেও রেডিও প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। কোনো রেডিও সম্প্রচার স্টেশনের স্টুডিওতে যখন কেউ মাইক্রোফোনে কথা বলে, তখন সেই শব্দ বিদ্যুৎ তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়। আমরা ২০ Hz থেকে ২০,000 Hz কম্পাঙ্ক পর্যন্ত শুনতে পারি কাজেই শব্দ থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গে রূপান্তরিত সিগন্যালটিও এই কম্পাঙ্কের হয়। এটিকে পাঠানোর জন্য উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গের সাথে যুক্ত করা হয়। এই উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বাহক তরঙ্গ বলে বাহক তরঙ্গের সাথে যুক্ত করার এই প্রক্রিয়াটিকে মডুলেশন বলা হয়। এই মডুলেটেড তরঙ্গ এমপ্লিফায়ার দিয়ে বিবর্ধন করা হয় এবং এন্টেনার সাহায্যে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা রেডিও তরঙ্গ ভূমি তরঙ্গ হিসেবে কিংবা বায়ুমণ্ডলের আয়োনোস্পিয়ারে প্রতিফলিত হয়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে (চিত্র ১৩.০৭)। গ্রাহক যন্ত্রের ভেতর যে এন্টেনা থাকে সেটি এই রেডিও তরঙ্গকে বিদ্যুৎ তরঙ্গে রূপান্তর করে নেয়। এরপর প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে বাহক তরঙ্গ থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়— এই প্রক্রিয়াটিকে ডিমডুলেশন বলা হয়। ডিমডুলেটেড বৈদ্যুতিক সিগন্যালটিকে এমপ্লিফায়ার দিয়ে বিবর্ধন করে শোনার জন্য স্পিকারে পাঠানো হয় ।রেডিও তরঙ্গ হিসেবে পাঠানোর জন্য রেডিও সম্প্রচার স্টেশনগুলো আলাদা আলাদা কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে। গ্রাহক যন্ত্রও নির্দিষ্ট কোনো স্টেশন শুনতে হলে সেই কম্পাঙ্কের সিগন্যালে টিউন করে নেয়— তাই আলাদা আলাদা রেডিও স্টেশন সবাই নিজের অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে এবং শ্রোতারা নিজের পছন্দের রেডিও স্টেশনের অনুষ্ঠান শুনতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গ্রাহক তরঙ্গের উচ্চতা বা বিস্তার বাড়িয়ে বা কমিয়ে (Amplitude Modulation) সিগন্যালটি সংযুক্ত করা হয় বলে এই পদ্ধতিটির নাম AM রেডিও। যদি বিস্তার সমান রেখে কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করে মডুলেট করা হতো (Frequency Modulation) তাহলে এই পদ্ধতিকে বলা হতো FM রেডিও।
১৩.৪.২ টেলিভিশন
তোমরা সবাই টেলিভিশন দেখেছ এবং জান যে টেলিভিশন এমন একটি যন্ত্র, যেখানে দূরবর্তী কোনো টেলিভিশন সম্প্রচার স্টেশন থেকে শব্দের সাথে সাথে ভিডিও বা চলমান ছবিও (চিত্র ১৩.০৮) দেখতে পাই। ১৯২৬ সালে জন লঞ্জি বেরার্ড প্রথম টেলিভিশনের মাধ্যমে ভিডিও বা চলমান ছবি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পদ্ধতিটি ছিল একটি যান্ত্রিক পদ্ধতি, পরে ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে ছবি পাঠানোর পদ্ধতিটি আরো আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।রেডিও ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার কীভাবে কাজ করে সেটি যদি তোমরা বুঝে থাকো তাহলে টেলিভিশন কীভাবে কাজ করে সেটিও সহজেই বুঝতে পারবে। টেলিভিশনে শব্দ এবং ছবি আলাদা সিগন্যাল হিসেবে পাঠানো হয়। শব্দ পাঠানোর এবং গ্রাহক যন্ত্রে সেটি গ্রহণ করে শোনার বিষয়টি ইতোমধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। তখন সেগুলোকে আলাদা আলাদা স্থিরচিত্র মনে না হয়ে একটি চলমান ছবি বলে মনে হয়। টেলিভিশনে রঙিন ছবি পাঠানোর জন্য টেলিভিশন ক্যামেরা প্রতিটি ছবিকে লাল-সবুজ ও নীল (RGB) এই তিনটি মৌলিক রংয়ে ভাগ করে তিনটি আলাদা ছবি তুলে নেয়। টেলিভিশন ক্যামেরার ভেতরে আলো CCD (Charge Coupled Device) ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তরিত করা হয়। এই বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে উচ্চ কম্পাঙ্কের বাহক তরঙ্গ ব্যবহার করে এন্টেনার ভেতর দিয়ে পাঠানো হয় (চিত্র ১৩.০৯)।
গ্রাহক যন্ত্র বা টেলিভিশন সেট তার এন্টেনা দিয়ে উচ্চ কম্পনের বাহক তরঙ্গকে গ্রহণ করে এবং রেকটিফায়ার দিয়ে বাহক তরঙ্গকে সরিয়ে মূল ছবির সিগন্যালকে বের করে নেয়। আগে এই সিগন্যাল থেকে তিন রংয়ের তিনটি ছবিকে ক্যাথোড রে টিউব নামের পিকচার টিউবে তার ক্ষিনে ইলেকট্রন গান দিয়ে প্রক্ষেপণ করা হতো। এখন পিকচার টিউব প্রায় উঠে গিয়েছে এবং এলইডি (Light Emitting Diode) টেলিভিশন তার জায়গা দখল করেছে। এখানে ইলেকট্রন গান দিয়ে কিনে ছবি তৈরি না করে লাল সবুজ ও নীল রংরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলইডিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে ছবি তৈরি করা হয়। এলইডি টেলিভিশনে ছবির ঔজ্জ্বল্য অনেক বেশি এবং গুণগত মানও অনেক ভালো।এখানে উল্লেখ্য যে এন্টেনার সাহায্যে টেলিভিশনের সিগন্যাল পাঠানো ছাড়াও কো-এক্সিয়াল ক্যাবল দিয়েও সিগন্যাল পাঠানো হয়। এই ধরনের টিভির সম্প্রচার ক্যাবল টিভি নামে পরিচিত। এছাড়াও স্যাটালাইট টিভি নামে এক ধরণের টিভি অনুষ্ঠানের সম্প্রচার করা হয়, এটি মহাকাশে পাঠানো উপগ্রহ বা স্যাটালাইট থেকে সরাসরি পৃথিবীতে পাঠানো হয় ।
১৩.৪.৩ টেলিফোন ও ফ্যাক্স:
টেলিফোন (চিত্র ১৩.১০) হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা এখন এই টেলিফোন ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে একজন মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
ল্যান্ডফোন
১৮৭৫ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন, নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেটি বর্তমান আধুনিক টেলিফোনে রূপ নিয়েছে, কিন্তু তার মূল কাজ করার প্রক্রিয়াটি ঠিক এখনো আগের মতোই আছে। চিত্র ১৩.১৩: ল্যান্ডফোন এবং মোবাইল বা সেলুলার ফোন। তোমরা সবাই টেলিফোন দেখেছ এবং ব্যবহার করেছ। টেলিফোন পাঁচটি উপাংশ থাকে।
(ক) সুইচ : যেটি মূল টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত অথবা বিচ্ছিন্ন করে
(খ) রিংগার: যেটি শব্দ করে জানিয়ে দেয় যে কেউ একজন যোগযোগ করেছে
(গ) কি-প্যাড: যেটি ব্যবহার করে একজন অন্য একজনকে ডায়াল করতে পারে
(ঘ) মাইক্রোফোন: যেটি আমাদের কণ্ঠস্বরকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে পরিবর্তন করে
(ঙ) স্পিকার: যেটি বিদ্যুতিক সিগন্যালকে শব্দে রূপান্তর করে শোনার ব্যবস্থা করে দেয়।প্রত্যেকটি টেলিফোনই তামার তার দিয়ে আঞ্চলিক অফিসের সাথে যুক্ত থাকে। আমরা যখন কথা বলার জন্য কোনো নম্বরে ডায়াল করি, তখন আঞ্চলিক অফিসে সেই তথ্যটি পৌঁছে যায়। সেখানে একটি সুইচ বোর্ড থাকে যেটি নির্দিষ্ট গ্রাহকের টেলিফোনের সাথে যুক্ত করে দেয়। যদি আমরা অনেক দূরে কিংবা ভিন্ন কোনো দেশে একজনের সাথে কথা বলতে চাই, তাহলে সুইচবোর্ড সেভাবে আমাদেরকে নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে দেয়। প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার আগে যখন পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুইজন মানুষ টেলিফোনে কথা বলত, তখন কথাবার্তা পাঠানোর জন্য তাদের টেলিফোনকে তামার তার দিয়ে সংযুক্ত করে দিতে হতো, সে কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল অনেক খরচ সাপেক্ষ। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থায় পুরোটা অনেক সহজ হয়ে গেছে, এখন একটি অপটিক্যাল ফাইবারে একই সাথে আক্ষরিক অর্থে লক্ষ লক্ষ মানুষের কথাবার্তা পাঠানো সম্ভব তাই টেলিফোন কথাবার্তা বলার বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।মোবাইল টেলিফোন ল্যান্ডফোন যেহেতু তামার তার দিয়ে যুক্ত তাই এটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হয় এবং টেলিফোন করার জন্য কিংবা টেলিফোন ধরার জন্য সেই জায়গাটিতে আসতে হয়। মোবাইল টেলিফোন আমাদের সেই বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং এই টেলিফোনটি আমরা আমাদের সাথে রেখে যেকোনো জায়গায় যেতে পারি এবং যতক্ষণ আমরা নেটওয়ার্কের ভেতরে আছি, যেকোনো নম্বরে ফোন করতে পারি, কথা বলতে কিংবা এস.এম.এস বিনিময় করতে পারি। সে কারণে মোবাইল ফোন এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম।
তোমরা সবাই দেখেছ মোবাইল টেলিফোন কোনো তার দিয়ে যুক্ত নয়—যার অর্থ এটি ওয়ারলেস বা রেডিও তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ করে থাকে। কাজেই প্রত্যেকটি মোবাইল টেলিফোন আসলে একই সাথে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার এবং রেডিও রিসিভার।ল্যান্ড টেলিফোনে যে যে যান্ত্রিক উপাংশ থাকা প্রয়োজন, মোবাইল টেলিফোনেও সেগুলো কোনো না কোনো রূপে থাকতে হয়, তার সাথে আরো কয়েকটি বাড়তি বিষয় হয়। সেগুলো হচ্ছে
(a) ব্যাটারি: এই ব্যাটারি দিয়ে মোবাইল ফোনের জন্যে বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করা হয়
(b) স্ক্রিন: এই স্ক্রিনটিতে মোবাইল ফোনের যোগাযোগের তথ্য দেখানো হয়
(c) সিম কার্ড: (SIM : Subscriber Identity Module) যেখানে ব্যবহারকারীর তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা হয়
(d) রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার : এগুলো দিয়ে মোবাইল ফোন তার নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করে
(e) ইলেকট্রনিক সার্কিট: এটি মোবাইল টেলিফোনের জটিল কার্যক্রমকে ঠিকভাবে সম্পাদন করতে সাহায্য করে।
মোবাইল টেলিফোনে যোগাযোগ করার কাজটি সম্পন্ন করার জন্য পুরো এলাকাকে অনেকগুলো সেলে (Cell) ভাগ করে নেয় (চিত্র ১৩.১১) এজন্য মোবাইল টেলিফোনকে অনেক সময় সেলফোনও বলা হয়। এই সেলগুলো প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে ১ কিলোমিটার থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। প্রত্যেকটা সেলে একটি করে বেস স্টেশন (BTS Base Transceiver Station) থাকে। একটি এলাকার অনেকগুলো বেস স্টেশন একটা বেস স্টেশন কন্ট্রোলারের (BSC: Base Station Controller) মাধ্যমের মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রের (MSC: Mobile Serviece Switching) সাথে যোগাযোগ করে। মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রটি মোবাইল নেটওয়ার্কের একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এখানে প্রেরক আর গ্রাহকের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।কেউ (প্রেরক) যখন তার মোবাইল ফোনে অন্য কোনো নাম্বারে (গ্রাহকের) ডায়াল করে, তখন প্রেরকের মোবাইল ফোনটি সে যে সেলে আছে তার বেস স্টেশনের (BTS) সাথে যুক্ত হয়। সেই বেস স্টেশন থেকে তার কলটি বেস স্টেশন কন্ট্রোলারের (BSC) ভেতর দিয়ে মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রে (MSC) পৌঁছায়। মোবাইল সুইচিং কেন্দ্র তার কাছে রাখা তথ্যভাণ্ডার থেকে গ্রাহক সেই মুহূর্তে কোন সেলের ভেতর আছে সেটি খুঁজে বের করে। তারপর প্রেরকের কলটি গ্রাহকের সেই সেলের বেস স্টেশনের সাথে যুক্ত করে দেয় এবং সেই বেস স্টেশন থেকে গ্রাহকের মোবাইল ফোনে রিং দেওয়া হয়।মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ককে সচল রাখার জন্য অনেক ধরনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের মোবাইল টেলিফোন থেকে খুবই কম শক্তির সিগন্যাল ব্যবহার করে কাছাকাছি বেস স্টেশনের সাথে যুক্ত করা হয় এবং আমরা যদি একটি সেল থেকে অন্য সেলে চলে যাই, এই নেটওয়ার্ক সেটি জানতে পারে এবং এক বেস স্টেশন থেকে অন্য বেস স্টেশনে যোগাযোগটি স্থানান্তর করে দেয়। একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যদি অনেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী থাকে, তাহলে ছোট ছোট অনেকগুলো সেল দিয়ে তাদের ফোন করার সুযোগ দেওয়া হয়। আবার গ্রামের কম জনবসতি এলাকায় একটি অনেক বড় সেল দিয়ে পুরো এলাকাতে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত রাখা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে শুরুতে শুধু কথা বলার জন্য টেলিফোন উদ্ভাবন করা হয়েছিল। মোবাইল টেলিফোনে কথার সাথে সাথে এস.এম.এস. পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন স্মার্টফোন নামে নতুন যে ফোনগুলো এসেছে, সেগুলো কণ্ঠস্বরের (Voice) সাথে সাথে সব ধরনের তথ্য (Data) পাঠাতে পারে। কাজেই সেগুলো সরাসরি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পারে এবং আগে যে কাজগুলো কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছাড়া করা সম্ভব ছিল না, সেগুলো এই স্মার্ট ফোন দিয়ে করা সম্ভব হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই স্মার্টফোনগুলোর জন্য নানা ধরনের অ্যাপ (Application) তৈরি হচ্ছে, সেগুলো দিয়ে স্মার্টফোন আমাদের আরো নানা ধরনের কাজ করতে সাহায্য করে।স্মার্টফোন একদিকে আমাদের জীবনযাত্রার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, একই সাথে খুব সহজে স্মার্টফোনে ইন্টারনেটে যুক্ত হওয়ার সুযোগের কারণে নতুন প্রজন্ম সামাজিক নেটওয়ার্ক-জাতীয় বিষয়গুলোতে অনেক অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করছে, সেটি এই মুহূর্তে শুধু আমাদের দেশের নয় সারা পৃথিবীর একটি বড় সমস্যা।
ফ্যাক্স
ফ্যাক্স শব্দটি হচ্ছে ফ্যাক্সিমিল (Facsimile)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ফ্যাক্স করা বলতে আমরা বোঝাই কোনো ডকুমেন্টকে কপি করে টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া। বর্তমান যুগে কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এই ফ্যাক্স প্রযুক্তিকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে, তারপরও প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এখনো এই প্রাচীন কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। শুনে অবাক লাগতে পারে, ফ্যাক্স পাঠানো হয় টেলিফোন লাইন দিয়ে কিন্তু প্রথম ফ্যাক্সের ধারণাটি পেটেন্ট করা হয় টেলিফোন আবিষ্কারেরও ত্রিশ বছর আগে।
ফ্যাক্স মেশিন একই সাথে একটা ডকুমেন্টের কপি পাঠাতে পারে এবং এই মেশিনে পাঠানো একটি কপিকে প্রিন্ট করে দিতে পারে। ফ্যাক্স মেশিনে যখন একটি ডকুমেন্ট দেওয়া হয়, তখন সেখানে উজ্জ্বল আলো ফেলা হয়, ডকুমেন্টের কালো অংশ থেকে কম এবং সাদা অংশ থেকে বেশি আলো প্রতিফলিত হয়, সেই তথ্য গুলো সংরক্ষণ করে ডকুমেন্টটির কপিকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর করে টেলিফোন লাইন দিয়ে পাঠানো হয় ।টেলিফোন লাইনের অন্য প্রান্তে ফ্যাক্স মেশিনটি তার কাছে পাঠানো ডকুমেন্টের কপিটিকে একটি প্রিন্টারে প্রিন্ট করে দেয় (চিত্র ১৩.১২)। ফ্যাক্স মেশিন এখনো একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি, এটি একটি ডকুমেন্টের কপিটিকে শুধু সাদা এবং কালো হিসেবে পাঠানো হয় বলে লিখিত ডকুমেন্টের জন্য ঠিক থাকলেও রঙিন কিংবা ফটোগ্রাফের জন্য উপযুক্ত নয়। এছাড়া বেশিরভাগ ফ্যাক্স মেশিনে থার্মাল পেপার ব্যবহার করা হয় বলে ডকুমেন্টটি খুব তাড়াতাড়ি অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে।
১৩.৪.৪ রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট সমস্যা
রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, সেগুলো প্রধানত শব্দদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। অনেকেই খুব হাই-ভলিয়ুমে রেডিও টেলিভিশন ব্যবহার করে। এতে নিজের কানের যেমন সমস্যা হতে পারে, তেমনি আশপাশে যারা থাকে, তাদেরও সমস্যা হতে পারে। যারা কানে হেডফোন লাগিয়ে সারাক্ষণ খুব বেশি শব্দে রেডিও বা মিউজিক শোনে, তারা মাথাব্যথা, কানে কম শোনা— এরকম স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়তে পারে।এছাড়া যারা দিনে তিন-চার ঘণ্টা থেকে বেশি টিভি দেখে, তাদের মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতা, চোখে ব্যথা বা চেখের দৃষ্টি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়তে পারে। এ প্রতিক্রিয়াগুলো শিশুদের জন্য অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাদের বিকাশমান কোষের যথোপযুক্ত বিকাশে টেলিভিশন থেকে নিঃসৃত বিকিরণ যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে।যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা সহজ। তাই শব্দদূষণ বা অন্যান্য সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে উচ্চ শব্দে রেডিও বা টিভি না চালানো, একনাগাড়ে অধিক সময় রেডিও এবং টিভি না শোনা বা না দেখা ভালো। শুধু তাই নয়, টেলিভিশন থেকে নিঃসৃত বিকিরণ থেকে রক্ষা পেতে টেলিভিশন থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে টিভি দেখতে হবে।
পৃথিবীতে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে এবং এর পিছনে শিশুদের অল্প বয়সে টেলিভিশন দেখার একটি যোগসূত্র থাকতে পারে। সেজন্য অটিস্টিক শিশুদের পরিবারে ডাক্তারেরা টেলিভিশন না দেখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।এরপর আসা যাক, মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে। মোবাইল ফোন হলো একটি নিম্ন ক্ষমতার রেডিও ডিভাইস, যা একটি ছোট এন্টেনার সাহায্যে একই সাথে রেডিও কম্পাঙ্কে বিকিরণ, প্রেরণ এবং গ্রহণ করে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় এ এন্টেনাটি ব্যবহারকারীর মাথার খুব কাছে থাকে। এ নিয়ে পৃথিবীর মানুষ এখন উদ্বিগ্ন যে এই মাইক্রো তরঙ্গের ক্রমাগত ব্যবহার হয়তো মাথায় ক্যান্সার রোগের সৃষ্টি করতে পারে। এসব সমস্যার সৃষ্টি সম্পর্কে খুব বেশি প্রমাণ নেই। তবু অত্যধিক বিকিরণ থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিকিরণের প্রভাব খুব বেশি না পড়লেও শিশুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ, এ বিকিরণ শিশুদের মস্তিস্কের কোষ বিকাশে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে সাবধান করা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছে। কিন্তু আমরা যদি এই প্রযুক্তি সুবিবেচকের মতো ব্যবহার না করে অবিবেচকের মতো অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করি, তাহলে খুব সহজেই আমাদের জীবনে আরো বড় নতুন নতুন জটিলতা হাজির হতে পারে।
১৩.৫.১ কম্পিউটার
তোমরা সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করেছ। যারা একটু ইতস্তত করছ, তাদেরকে বলা যেতে পারে কম্পিউটার বলতেই যাদের চোখের সামনে একটা মনিটর, একটা সিপিইউ বা কি-বোর্ড কিংবা ল্যাপটপের ছবি ভেসে ওঠে— শুধু সেগুলোই কম্পিউটার নয়। আমরা যে মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার করি, তার মাঝেও ছোট ছোট এবং পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার রয়েছে।আধুনিক জগতে কম্পিউটারের গুরুত্বটি বিশাল। তার কারণ এটি অন্য দশটি যন্ত্রের মতো নয়। অন্য যেকোনো যন্ত্র বা টুল (Tool) সব সময়েই একটা নির্দিষ্ট কাজ করতে পারে। একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে বাশি বাজানো সম্ভব নয় আবার বাঁশি দিয়ে স্ক্রু খোলা যায় না। কিন্তু কম্পিউটার এমন একটা যন্ত্ৰ, যেটা দিয়ে সম্ভাব্য সকল কাজ করা যায় এবং কী কী করা যাবে তার সীমারেখা মাত্র একটি এবং সেটি হচ্ছে মানুষের সৃজনশীলতা একজন মানুষ যত সৃজনশীল সে কম্পিউটারের তত বেশি ব্যবহার বের করতে পারবে। তাই কম্পিউটার দিয়ে আমরা যে রকম হিসাব (compute) করতে পারি, ঠিক সে রকম গান শুনতে পারি, ছবি আঁকতে পারি, তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি, যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, এমনকি যারা ঘাগু অপরাধী, তারা এটা ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারণা পর্যন্ত করে ফেলে।
কম্পিউটারের গঠন: যারা কম্পিউটারের ভেতর উঁকি দিয়েছ, নিঃসন্দেহে তাদের মনে হতে পারে এটি খুবই জটিল একটি যন্ত্র, কিন্তু তোমরা জেনে খুশি হবে, এর কাজ করার মূল বিষয়টি খুবই সহজ। একটা কম্পিউটারের মূল অংশ দুটি: একটি হচ্ছে মাইক্রোপ্রসেসর, অন্যটি হচ্ছে মেমোরি। (চিত্র ১৩.১৩) মেমোরির ভেতর নানা ধরনের নির্দেশ বা ইনস্ট্রাকশন জমা করা থাকে, সেগুলো কিছু ডিজিটাল সিগন্যাল ছাড়া আর কিছুই নয়। মেমোরি থেকে এই ইনস্ট্রাকশনগুলো মাইক্রোপ্রসেসরে পাঠানো হয়, মাইক্রোপ্রসেসর কোন ইনস্ট্রাকশনের জন্য কী করতে হবে, সেটি জানে এবং তার জন্য বরাদ্দকৃত কাজটি শেষ করে এবং যখন প্রয়োজন হয়, তখন ফলাফলটি আবার মেমোরিতে জমা করে দেয়। এভাবে মেমোরিতে রাখা সবগুলো ইনস্ট্রাকশন শেষ করা হলে আমরা বলে থাকি এটা তার প্রোগ্রাম পুরোটা শেষ করেছে। কম্পিউটারের তথ্য সংরক্ষণ করার জন্য শুধু মেমোরির ওপর নির্ভর করা হয় না, পাকাপাকিভাবে সেখানে তথ্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়, সেটাকে আমরা হার্ড ড্রাইভ বলে থাকি।
কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম চালাতে হলে তার সাথে বাইরে থেকে যোগাযোগ করতে হয়। যেসব যন্ত্রপাতি (কি-বোর্ড কিংবা মাউস) দিয়ে কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করা হয়, তাদেরকে বলা হয় ইনপুট ডিভাইস। কম্পিউটার আবার তার তথ্য ব্যবহারকারীর কাছে দিতে পারে, যেসব যন্ত্রপাতি দিয়ে কম্পিউটার বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করে (মনিটর, প্রিন্টার), তাকে বলা হয় আউটপুট ডিভাইস।
তবে আজকাল কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। প্রত্যেকটা কম্পিউটারেই নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস কার্ড (NIC: Network Interfacing Card), থাকে যেটি দিয়ে সেটি একটি নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকে এবং কম্পিউটার সেটি দিয়ে তথ্য গ্রহণ করে আবার তথ্যকে প্রেরণ করে।
১৩.৫.২ ইন্টারনেট ও ই-মেইল
ইন্টারনেট
তোমরা এর মাঝে অনেকবার কম্পিউটার কী এবং সেটা কীভাবে কাজ করে, সেটা পড়ে এসেছ। একটা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারগুলোকে সাধারণত একটা নেটওয়ার্ক দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয় যেন একটা কম্পিউটার অন্য একটা কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, আবার প্রয়োজন হলে একটা কম্পিউটার অন্য কম্পিউটারের Resource ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের নেটওয়ার্ককে LAN (Local Area Network) বলা হয়ে থাকে। আজকাল LAN তৈরি করার জন্য একটা সুইচের সাথে অনেকগুলো কম্পিউটার যুক্ত করে সুইচগুলোকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে দিতে হয়। যখন একটা কম্পিউটারকে অন্য কম্পিউটারের যোগাযোগ করতে হয়, সেটি যদি তার নিজের সুইচের সাথে যুক্ত কম্পিউটারের মাঝে পেয়ে যায় তাহলে তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে। সেখানে না পেলে অন্য সুইচে খোঁজ করতে থাকে ।
একটি প্রতিষ্ঠানের একটি LAN-কে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের অন্য একটি LAN-এর সাথে যুক্ত করার জন্য রাউটার (Router) ব্যবহার করা হয়। (চিত্র ১৩.১৪) বিভিন্ন নেটওয়ার্ক (Network)-এর নিজেদের মাঝে Inter Connection করে Networking-কে Internet বলা হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় নয় বিলিয়ন কম্পিউটার বা অন্য কোনো ডিভাইস ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত আছে এবং সংখ্যাটি প্রতিদিনই বাড়ছে।
কাজেই ইন্টারনেট হচ্ছে নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক, যেখানে প্রাইভেট, পাবলিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা- বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি স্থানীয় বা বৈশ্বিক সব ধরনের নেটওয়ার্কগুলো জড়িত হয়েছে। এই বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য নানা ধরনের ইলেকট্রনিক, ওয়ারলেস এবং ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।ইন্টারনেট ব্যবহার করে এখন নানা ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা যায় এবং নানা ধরণের সেবা দেয়া যায়। উদাহরণ দেওয়ার জন্যে বলা যেতে পারে, ইন্টারনেটে রয়েছে নানা ধরনের ওয়েব সাইট, ইলেকট্রনিক মেইল, টেলিফোন এবং ভিডিও যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান, সামাজিক নেটওয়ার্ক, বিনোদন, শিক্ষা এবং গবেষণা টুল এবং নানা ধরনের ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা। সারা পৃথিবীর মানুষ এখন ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং আমাদের জীবনধারার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, ইন্টারনেটে পৃথিবীর সকল মানুষেরই যোগাযোগ করার সমান সুযোগ আছে বলে নানা ধরনের প্রচার এবং অপপ্রচারে ব্যবহার এবং অপব্যবহার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নানা ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যার তৈরি করে নেটওয়ার্কের ক্ষতি করা, বিদ্বেষ এবং হিংসা ছড়ানো আপত্তিকর তথ্য উপস্থাপন ছাড়াও অপরাধীরাও তাদের কার্যক্রমে গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।কিছু নেতিবাচক বিষয় থাকার পরও ইন্টারনেট এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান এবং এই প্রথমবার পৃথিবীর সকল মানুষ সমানভাবে একটি প্রযুক্তিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এই নেটওয়ার্কের কী প্রভাব পড়বে, তা দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ই-মেইল
ইলেকট্রনিক মেইলের সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ই-মেইল এবং ই-মেইল বলতে আমরা বোঝাই কম্পিউটার, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন ইত্যাদি ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে একজন বা অনেকজনের সাথে ডিজিটাল তথ্য বিনিময় করা। ১৯৭১ সালে প্রথম ই-মেইল পাঠানো হয় এবং মাত্র ২৫ বছরের ভেতরে পোস্ট অফিস ব্যবহার করে পাঠানো চিঠি থেকে ই-মেইলের সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ই-মেইলের ব্যবহার ছাড়া আমরা একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না।ই-মেইল পাঠানোর জন্য প্রথমেই যিনি পাঠাবেন এবং যিনি পাবেন দুজনেরই ই-মেইলের ঠিকানার দরকার হয়। তোমরা সবই ই-মেইল ঠিকানার সাথে পরিচিত এবং সবাই লক্ষ্য করেছ ই-মেইল ঠিকানাটি @ বর্ণটি দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। যদি abc@def.com একটি ই-মেইল ঠিকানা হয়ে থাকে তাহলে @ এর পরের অংশটুকু হচ্ছে ডোমেইন নেইম, যেটা দিয়ে বোঝানো হয় ব্যবহারকারী কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। প্রথম অংশটুকু হচ্ছে ব্যবহারকারীর কোনো ধরনের পরিচয়।
কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে ই-মেইল পাঠাতে হলে সবসময়েই একটি ই-মেইল সার্ভারের দরকার হয়। এই ই-মেইল সার্ভার ব্যবহারকারীদের ই-মেইল সংরক্ষণ করে এবং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্য ব্যবহারকারীদের সাথে ই-মেইল বিনিময় করে। ই-মেইল বিনিময় করার আরেকটি এবং বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে ইন্টারনেটের দেওয়া ই-মেইল সার্ভিস। তাদের মাঝে রয়েছে Gmail, Yahoo, Hotmail ইত্যাদি ই-মেইলের সেবা শুধু যে বিনামূল্যে দেওয়া হয় তা নয়, ব্যবহারকারীর ই-মেইল সংরক্ষণ করার দারিত্বও গ্রহণ করে থাকে। ই-মেইল পাঠানোর জন্য সবসময় প্রেরণকারী এবং গ্রাহকের ই-মেইল ঠিকানা লিখতে হয়। একটি ই-মেইল একাধিক গ্রাহকের কাছে পাঠানো যায়। প্রয়োজনে ই-মেইলকে অন্য একজনকে “কার্বন কপি” হিসেবে (CC) পাঠানো যায়। ই-মেইলের শুরুতে বিষয় হিসেবে ই-মেইলের বক্তব্যটির একটি শিরোনাম লেখা যায়। শুধু তা-ই নয় ই-মেইলের বিষয়বস্তু লেখার পাশাপাশি তার সাথে অন্য কোনো ডকুমেন্ট, ছবি সংযুক্ত করে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। আমরা ই-মেইল ছাড়া এখন একটি মূহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। ই-মেইল, ইন্টারনেট কিংবা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্ক আমাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। একই সাথে এই প্রযুক্তিগুলোর অপব্যবহার আমাদের জীবনে খুব সহজেই বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। কাজেই এটা বলা বাহুল্য, অত্যন্ত শক্তিশালী এই প্রযুক্তিগুলো আমাদের দায়িত্বশীলের মতো ব্যবহার করতে হবে। উল্লেখ্য, এই বিষয়টি শুধু তথ্যপ্রযুক্তি নয়, সকল প্রযুক্তির জন্য সত্যি।
কাজ: ই-মেইল, ইন্টারনেট কিংবা সামাজিক নেটওয়ার্কে দায়িত্বহীন হিসেবে কী কী ব্যবহার করা সম্ভব তার তালিকা তৈরি কর। |
১৩.৫.৩ কম্পিউটার প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা
তথ্য ও প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপক ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যারা রোজই মাত্রাতিরিক্ত সময় ধরে কম্পিউটারের কোনো গেইম খেলে, তারা হাতের আঙ্গুলের মাথায় সুই ফুটানোর মতো ব্যথা অনুভব করা এমনকি আঙ্গুলের মাথায় ফোস্কা পড়া, আঙ্গুল ফুলে যাওয়ার মতো স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে।যারা অধিকক্ষণ ধরে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে, কম্পিউটারের কি-বোর্ড ও মাউসের দীর্ঘক্ষণ ও দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে তাদের হাতের রগ, স্নায়ু, কব্জি, বাহুতে, কাঁধ ও ঘাড়ে অতিরিক্ত টান ( stress) বা চাপ পড়ে। কাজেই কাজের ফাঁকে যথেষ্ট বিশ্রাম না নিলে এসব অঙ্গ ব্যথাসহ নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম না নিয়ে দীর্ঘদিন ও দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের কাজ করলে চোখে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়, একে বলা হয় কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম। এই সিনড্রেমের মধ্যে রয়েছে চোখ জ্বালাপোড়া করা, চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চোখ চুলকানো, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া ।
প্রতিকারের উপায়: কম্পিউটার ব্যবহার থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার চাইতে এই সমস্যা সৃষ্টি হতে না দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের সতর্ক হতে হবে যেন এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি না হয়। হাত, হাতের কব্জি, আঙ্গুল, কাঁধ ও ঘাড়ের সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার জন্য যা করতে হবে তা হলো :
১. কম্পিউটারের কাজ করার সময় সঠিকভবে বসতে হবে এবং সোজা সামনে তাকাতে হবে।
২. সঠিক পদ্ধতিতে টাইপ করতে হবে। টাইপ করার সময় হাতে যেন কোনো কিছুর ওপর রাখা না থাকে এবং হাত ও আঙ্গুল যেন সোজা থাকে ।
৩. কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্তত আধা ঘণ্টা পর পর ৫ মিনিটের জন্য হলেও বিশ্রাম নিতে হবে এবং
কাঁধ ও ঘাড়কে রিল্যাক্স করতে দিতে হবে।
কম্পিউার ভিশন সিনড্রোমের কারণে সৃষ্ট চোখের সমস্যা প্রতিরোধ যেসব সতর্কতা অবলম্বন করবে তা হলো:
১. তোমার কম্পিউটারের পর্দাটি যেন অবশ্যই তোমার চোখ থেকে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার দূরে থাকে।
২. কোনো ডকুমেন্ট হোল্ডার ব্যবহার করলে তা অবশ্যই পর্দার কাছাকাছি রাখবে।
৩. মাথার ওপরকার বাতির আলো এবং টেবিলের বাতির আলো এমনভাবে কমিয়ে দিতে হবে তা যেন তোমার চোখে বা কম্পিউটারে পর্দায় না পড়ে।
৪. প্রতি ১০ মিনিট পর পর কিছুক্ষণের জন্য দূরের কোনো কিছুর দিকে তাকাবে, এতে চোখ আরামবোধ করবে।
এই সহজ কিছু নিয়ম মেনে চললেই কম্পিউটার ব্যবহারের কারনে শারীরিক সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
মানসিক সমস্যা
কম্পিউটার ব্যবহারে যেসব শারীরিক সমস্যা হতে পারে, তার চাইতে অনেক গুরুতর সমস্যা হচ্ছে মানসিক সমস্যা। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার কারণে আজকাল প্রার সবাই এটি ব্যবহার করতে পারে। ইন্টারনেটে একদিকে যেমন তথ্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে রাখা আছে, ঠিক সেরকম সামাজিক নেটওয়ার্ক জাতীয় সার্ভিসের মাধ্যমে অসচেতন ব্যবহারকারীদের মোহগ্রস্ত করে রাখার ব্যবস্থাও করে রাখা আছে। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখাতে শুরু করেছেন যে মানুষ যেভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে যায়, সেভাবে অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহার, ইন্টারনেট বা সামাজিক নেটওয়ার্কে আসর হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত কম্পিউটার গেম খেলে মৃত্যুবরণ করেছে এরকম উদাহরণও আছে। কাজেই সবসময়েই মনে রাখতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তি মাত্রই ভালো নয়, পৃথিবীতে যেমন অনেক অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর প্রযুক্তি আছে, ঠিক সেরকম ভালো প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সেটি আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে পারে।
অনুসন্ধান (২ পিরিয়ড)
তোমার গবেষণার উদ্দেশ্য হতে পারে: ১. অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা শনাক্তকরণ। ২. পেশাদার ও অপেশাদার কম্পিউটার ব্যবহাকারীদের স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না তা জানা। ৩. এসব স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টির কারণ জানা । ৪. ব্যবহারকারীদের বয়স ও ম্যাস্থ্য সমস্যার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা জানা। ৫. কী করে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় তা জানা।এরপর তোমাকে এলাকা চিহ্নিত করতে হবে এবং তারপর কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। কোনো কোনো সময় একই এলাকায় বেশি কম্পিউটার ব্যবহারকারী না-ও পেতে পার। তখন তোমাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং খুব বেশি ব্যবহারকারী থাকলে তাদের থেকে নমুনা নিতে হবে। এজন্য বন্ধুরা কাজ ভাগাভাগি করে নিতে পার। |
এরপর তোমাকে তোমার অনুসন্ধানের একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। এ প্রতিবেদনে ১. শিরোনাম ২. একটি ভূমিকা ৩. অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য ৪. অনুসন্ধানের নমুনা (অঞ্চল বা ব্যক্তি) ৫. অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি ৬. অনুসন্ধানের তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি ৭. অনুসন্ধানের ফলাফল ও মন্তব্য এবং সুপারিশ |
Read more